রেড ইন্ডিয়ান রূপকথা

 


 

নেক অনেক দিন আগের কথা। এক গভীর জঙ্গলে ওয়াউফি নামে এক শিকারি বাস করত। সে এতই দক্ষ শিকারি ছিল যে লোকে তাকে সাদা বাজপাখি বলে ডাকত। সে যেখানে থাকত সেই জায়গাতে অনেক জীবজন্তুর যাতায়াত ছিল। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় সে বেশ কিছু জীবজন্তু শিকার করে নিয়ে আসত। ওয়াউফির শরীর ছিল সিডার গাছের মতো। তার চকচকে চোখের ভিতর দিয়ে তারুণ্য ফুটে বেরোত। জঙ্গলে এমন কোন জন্তু ছিল না বা এমন কোনও পাখি ছিল না যাদের পথ সে অনুসরণ করতে পারত না।

একদিন সে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। এতটা দূরে আগে সে কোনদিন যায় নি। যেতে যেতে সে দেখল যে সেখানে গাছপালা অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তারপর সে ঘাস ও ঘাস ফুল দিয়ে ঘেরা গোল মতো একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হলো। সেখান থেকে ওয়াউফি অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলঅনেকটা দূরে সে দেখতে পেল যে দূরের গাছ পালার মধ্য দিয়ে কেমন যেন একটা আলোর রেখা ফুটে উঠেছে। সে বুঝতে পারল যে সে কোন তৃণভূমির কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই ভূমি বেশ প্রশস্ত, ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা। আর তার ভিতরে ফুটে উঠেছে হাজার হাজার সুন্দর ফুল।   

এরপর সে খোলা মাঠে খোলা আকাশের নীচে কোন নির্দিষ্ট পথ ছাড়াই হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে সে একটা গোল মত জায়গায় এসে পৌঁছাল। সেই জায়গাটি সবুজ ঘাস ও ফুলে ভর্তি। ওয়াউফির মনে হতে লাগল সে যেন দুলতে দুলতে চারদিকে ঘুরছে। ব্যাপারটাতে সে খুব অবাক হল, সে চারদিকে ঘুরছে অথচ কিছুতেই যেন গোল মতো জায়গায় ঢুকতে পারছে না। সেখানে শুধুই ঘাস আর ফুলের সমাহার। সেখানে কোন শুকনো পাতা গাছের শাখা প্রশাখা এমন কী কারো আসা-যাওয়ার পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। সে ভাবল যে বিষয়টা সম্বন্ধে জানতে গেলে পিছনে লুকিয়ে থেকে তার লক্ষ্য করা দরকার, যে কেন এই গোল স্থান এত নির্মল!

লুকিয়ে থাকতে থাকতে ওয়াউফি হঠাৎ যেন আকাশ থেকে ভেসে আসা হালকা সংগীতের সুর শুনতে পেল। যে দিক থেকে এই সুর ভেসে আসছিল ওয়াওফি সেদিকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর, সুমধুর ধ্বনি বন্ধ হওয়ার পর সে একটা ছোট্ট বস্তু দেখতে পেল। মনে হল যেন একখণ্ড গ্রীষ্মের আকাশে ভেসে আসা শুভ্র মেঘ। ধীরে ধীরে তা নেমে আসছিল পৃথিবীর বুকে। প্রথমে বস্তুটি খুব ছোট মনে হচ্ছিল। যেন একটু হাওয়াতেই তা উড়ে অনেক দূরে চলে যাবে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এটা বড় হয়ে উঠলো এবং আগত সুর যেন আরও বেশি স্পষ্ট হতে লাগলো, আর আরো বেশি মধুর হতে লাগলো। মাটির খুব কাছে এসে যাওয়ার পর মনে হল মেঘময় সেই বস্তুটি যেন একটি সুবৃহৎ সাজি। তার ভিতর বসে ছিল বার জন বোন, যেন পরম সৌন্দর্যের আধার।

বৃহৎ সাজি মাটি স্পর্শ করা মাত্র বোনেরা লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। তারপর তারা আনন্দ মুখরিত ভাবে নৃত্য শুরু করল। সেই সুন্দর গোল জায়গায় একটা চকচকে বল নিয়ে তারা পা দিয়ে খেলতে লাগল। পায়ে বল লাগলেই মন মাতানো সংগীতের সুন্দর সুরে চারদিক ভরে উঠতে শুরু করল। এই ভাবে বার জন বোন সংগীত মুখর পরিবেশে নাচ ও খেলায় মেতে উঠল।

ওয়াউফি লুকিয়ে থাকা অবস্থাতেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের এই সুন্দর নাচ ও খেলা দেখতে থাকল। মনে মনে সে সবাইকে প্রসাংশা করতে থাকলেও তাদের ছোট বোনকে আরও বেশি প্রাণবন্ত মনে হল। ছোট্ট বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ও তাকে আদর করতে ওয়াউফির বেশি বেশি করে ইচ্ছা জেগে উঠল, তাকে আপন করে নিতে মনে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। সে আর বেশি ক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। বার জনের মধ্যে পরম সৌন্দর্যের প্রতীক সব চেয়ে ছোট বোন, যে ওয়াউফির মনে দাগ কেটেছে, তার কাছে আসার জন্য সে সন্তর্পণে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু কোনও মানুষের উপস্থিতির কথা বুঝতে পেরেই বোনেরা বিদ্যুৎ গতিতে তারা বৃহৎ সাজিতে গিয়ে উঠে বসল। সাজি আকাশের ওপরে উঠে গেল। আকাশের বুকে ভাসতে ভাসতে চোখের আড়ালে চলে গেল।

তার দুর্ভাগ্যের জন্য আক্ষেপ করতে করতে চলে যাওয়া জাদুমন্ত্রের সাজির দিকে চেয়ে থেকে ওয়াউফি বলতে লাগল, "ওরা চলে গেল। আমি আর কোনও দিন ওঠের আর দেখতে পাব না।"

এই ঘটনার পর সে তার কুটীরে ফিরে গেল। কিন্তু তার মনের ভিতর এক ভালো না লাগা চেপে বসল। কুটীর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেক দূরে চলে আসল। কিন্তু একশের দিকে চাইলেই তার সব চেয়ে ভালো লাগা এক মাত্র বিষয় বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার মনের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে তুলল।

পরের দিন একই সময়ে তৃণভূমির বৃত্তাকার সেই স্থানে ওয়াউফি আবার এসে উপস্থিত হল। বৃত্তের বাইরে এক প্রকার নিরীহ প্রাণীর আকার ধারণ করে বড় ঘাসের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকল। তার উদ্দেশ্য ছিল যে যাতে করে তার উপস্থিতির কথা বার জন অপার্থিব বোন বুঝতে না পারে। ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে সে নিরীহ প্রাণীটির মতোই ধীরে ধীরে কচি ঘাসপাতা খেতে থাকল। তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পরেই সে দেখতে পেল মেঘের ভিতর দিয়ে সেই বৃহৎ সাজির মতো বস্তুটি নেমে আসছে। আর ঠিক আগের মতোই সংগীতের মধুর সুর চারিদিক ভরইয়ে তুলেছে। সে ধীরে ধীরে বৃত্তাকার জায়গার দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই বোনেরা তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে গেল। আবার ভায় পেয়ে তারা দ্রুত সাজির ভিতর গিয়ে বসে পড়ল।

সাজি কিছুটা ওপরে ওঠার পর বড় বোনদের একজন বলল, "মনে হয় ওই প্রাণী পৃথিবীতে মরণশীল জীব কী ভাবে খেলা করে তাই দেখানোর জন্য এসেছিল।"

ছোট বোন উত্তর দিল, "কোনও মতেই না। তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।"

তারপর সবাই একত্রে মন্ত্রের মতো কিছু জপ করতে লাগল এবং সাজিটি দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

ওয়াউফি তার রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিরক্তি সহকারে নিজের বাসায় ফিরল। এই দক্ষ শিকারির কাছেও রাত্রিটা বড় একঘেয়ে মনে হতে লাগল। তার সম্পূর্ণ হৃদয় অপার্থিব সেই ছোট বোনের স্মৃতিতে ভরে থাকল।

পরের দিন সে একটু আগেই বৃত্তাকার তৃণভূমিতে পৌঁছে গেল। তার মন বড়ই অস্থির, কিছুই ভালো লাগছিল না। অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল যেন তার প্রাণ যে কোনও সময় শরীর থেকে বেরিয়ে পড়বে। সে দুবার ব্যর্থ হয়েছে। তাই তৃতীয় বার যাতে ব্যর্থ না হয় সে জন্য ওয়াউফি নিখুঁত ভাবে তার পরিকল্পনায় মনোনিবেশ করল। কারণ এবারও ব্যর্থ হলে তা সহ্য করা ওয়াউফির পক্ষে কঠিন কাজ। সে কাছাকাছি একটা গাছের গুঁড়ি দেখতে পেল। নরম মখমলের মতো তা মস উদ্ভিদ দিয়ে ঢাকা। গুঁড়ির চারপাশে সে কিছু ছোট ছোট ইঁদুরকে খেলা করতে দেখল। তাদের ছোট আকৃতি দেখে সে এতই খুশি হল যে নিজেও একটি ইঁদুর হতে চাইল। তারা এদিক ওদিক দেখতে পারে, আবার অন্য কেউ ছোট ইঁদুর দেখে খুব একটা ভয়ও পেয়ে যাবে না।

এই ভেবে ওয়াউফি প্রথমে কাঠের গুঁড়িটা তুলে বৃত্তাকার স্থানের কাছেই মাটিতে বসিয়ে দিল। তারপর চুপিসারে সে ছোট্ট ইঁদুর হয়ে গেল। গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে সে উঁকি দিতে লাগল, আবার একটু করে খেলতে থাকল। এর মধ্যেও সে কিন্তু আকাশের দিকে লক্ষ্য রাখা বা ওপর থেকে ভেসে আসা শব্দ শোনার জন্য একটা কান পেতে রাখার কথা ভুলল না।

তাকে বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। নির্ধারিত সময়েই বোনেরা সুন্দর বৃত্তাকার জায়গায় এসে তাদের নাচ ও খেলা শুরু রে দিল।

কিন্তু তাদের ছোট বোন বলে উঠল, “ দেখ, গাছের ওই শুকনো গুঁড়িটা আগে ওখানে ছিল না।"

সে ভয় পেয়ে ছুটে সাজির কাছে চলে গেল। তার বড় বোনেরা শুধু হাসল। তারপর গুঁড়ির কাছে গিয়ে ওটাকে নাড়া দিতে দিতে ব্যঙ্গ করতে থাকল। সব ইঁদুর তাদের কাছে ধরা পরে গেল, এমনকী ইঁদুর রুপি ওয়াউফিও। হাসতে হাসতে বোনেরা একটা বাদে সব ইঁদুর মেরেও ফেলল। ছোট বোন ওই ইঁদুরটিকে তাড়া করছিল। যেই না সে তার রুপোর দণ্ড নিয়ে ওটিকে শেষ করে দিতে গেল, তক্ষুনি ওয়াউফি নিজের রূপ ধারণ করে তাকে জড়িয়ে ধরল। অপার্থিব ছোট বোনটি ওয়াউফির কাছে ছিল এক অমূল্য পুরস্কারের মতো। এই দৃশ্য দেখে অন্য বোনেরা ভয় পেয়ে ছুটে বৃহৎ সাজিতে গিয়ে উঠল আর আকাশের বুকে ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওয়াউফি সেই সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করল। স্ত্রীকে খুশি করার জন্য বা তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের সমস্ত রকমের দক্ষতা প্রদর্শন করে চলল। সে তার অশ্রু মুছিয়ে দিল, পৃথিবীর ভালো সবকিছুর গুণগান করতে লাগল ও নিজের বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে চলল। ওয়াউফি সর্বদাই নিজের স্ত্রীকে চোখে চোখে রাখত, কোনও অসুবিধা যাতে না হয় তা খেয়াল করত। বনপথে হাঁটা চলার সময় স্ত্রীর হাত যত্ন করে ধরে থাকত। ঘরে ফিরে এলে তার হৃদয় আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে যেত, মনে হত সে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ।

এই ভাবে দেখতে দেখতে মনের সুখে শীত-গ্রীষ্ম পেরিয়ে গেল। এক বসন্তে তাদের ঘরে ফুটফুটে একটি শিশু পুত্র জন্ম নিল। ফুলে ফুলে ঘরে থাকা বসন্ত তাদের কাছে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। পৃথিবীতে তাদের সুখ ও আনন্দর জন্য বেশি আর কী বা প্রয়োজন?

ওয়াউফির স্ত্রী প্রধান তারার ছোট কন্যা। পৃথিবীর সব কিছু তার যখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল, তখন তার পিতার ঘরে ফেরার জন্য মন উতলা হয়ে গেল। কিন্তু সঙ্গত কারণেই সে এই ইচ্ছার কথা তার স্বামীর কাছে প্রকাশ করল না। সাজিতে করে আকাশে উঠে যাওয়ার আকর্ষণের কথা তার বারবার মনে পড়তে লাগল। একদিন ওয়াউফি যখন শিকার তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, তখন সুযোগ বুঝে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট সাজির মতো বস্তু তৈরি করল এবং লুকিয়ে রাখল। ইতিমধ্য সে পৃথিবীর বিশেষ ধরনের কিছু দ্রব্য ও সুমিষ্ট ফলও সংগ্রহ করে রাখল। সে নিশ্চিত ছিল যে সেগুলি দেখলে তার বাবা খুব খুশি হবে।

একদিন ওয়াউফি বাসায় না থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী সঙ্গে তার পুত্র সন্তান ও সংগ্রহ করা সব কিছু সামগ্রী নিয়ে সুন্দর বৃত্তাকার স্থানে চলে গেল। সে সজিতে ওঠার পর জাদুর গান গাইতে শুরু করল। গানের শুর হয়ে উঠল করুণ ও বিষাদময়। সেই সুর ওয়াউফির কানে গিয়ে ধ্বনিত হল। গানের সুর ও কণ্ঠস্বর তার খুবই চেনা ঠেকল। সে বাজপাখির ন্যায় দ্রুত গতিতে সেই গোল তৃণভূমির কাছে ছুটে আসল। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে এলেও সেখানে পৌঁছানোর আগেই তার স্ত্রীর সাজি মাটির ওপরে উঠে গেল। সে সজোরে চিৎকার করে তাদের নীচে নেমে আসতে বলল, কিন্তু কোনও ফল হল না। সে আকশের দিকে তাকিয়ে থাকল - উড়ন্ত বস্তু তার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ছোট হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে গেল। ওয়াউফি তখন বসে পড়ে মাটিতে মাথা রেখে নিজেকে নিঃস্ব ও রিক্ত ভেবে নির্বাক হয়ে গেল।

দীর্ঘ শীত ও দীর্ঘ গ্রীষ্ম জুড়ে ওয়াউফি তার হারানো সম্পদের কথা বলে বিলাপ করে চলল, কিন্তু মনে কোনও শান্তি পেল না। যে অপার্থিব রত্নের সান্নিধ্য সে পেয়েছিল তা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিল। বারবার এই কথাই তার মনে হতে লাগল।

সে স্ত্রী হারানোর জন্য দারুণ ভাবে শোকার্ত, কিন্তু পুত্র হারানোর ব্যথা তাকে আরও বেশি কাতর করে তুলেছিল। কারণ পুত্রের মধ্যে সে দেখতে পেয়েছিল ছিল মায়ের রূপ আর বাবার ক্ষমতা।

ইতিমধ্যে ওয়াউফির স্ত্রী তারাদের মধ্যে তো পিতার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সময়ের সাথে সেখানে সুন্দর সুন্দর কাজের মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীতে তার স্বামীকে ছেড়ে আসার কথা আর মনেই ছিলনা। কিন্তু ছেলে বড় হতে লাগল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের চেহারা তার ওয়াউফির মতো হয়ে উঠতে থাকল। দিন দিন সে তার জন্ম স্থান দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠল।

এমত অবস্থায় সুন্দরী কন্যার পিতা তাকে বলল, "মা, সন্তানকে নিয়ে তুমি একবার তার পিতার কাছে ফিরে যাও। তাকে বল তারাদের দেশে এসে আমদের সঙ্গে থাকতে। এও বল, সে যত রকমের শিকার করে থাকে তাদের সবার নমুনা যেন নিয়ে আসে।"

সে মতো ছোট মেয়ে তার পুত্রকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এল। ওয়াউফি সেই সুন্দর স্থানের কাছাকাছিই ছিল। আকাশ থেকে নেমে আসার সময় তার স্ত্রীর কণ্ঠস্বর সে সুনতে পেল। স্ত্রী ও সন্তানকে দেখতে পেয়ে তার হৃদয়ের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। সে ছুটে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরল।

ওয়াউফি তার স্ত্রীর পিতার পাঠানো খবর শুনেছিল। তাই সে দিন রাত এক করে ও জঙ্গলের মধ্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ভালো ভালো শিকার সংগ্রহ করার চেষ্টা করে চলল। তারও ইচ্ছা ছিল যাতে করে পৃথিবীর এই উপহারে তারাদের দেশের সকলে খুশি হয়।

সবকিছু যখন ঠিকঠাক, ওয়াউফি বিদায়ের আগে তার প্রিয় স্থানগুলি আবার নতুন কারে ঘুরে নিল। পাহাড়ের চূড়া, যেখান থেকে সে সূর্য ওঠা দেখত, যে নদীতে সে সাঁতার কাটত, তার পুরাতন বাসা - সব কিছুই কেমন যেন তার মনে বেদনার সৃষ্টি করতে লাগল। সে তার প্রিয় সব কিছু ছেড়ে অন্য জগতে চলে যাচ্ছে, তাই মন খারাপ হওয়ারই কথা। অবশেষে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সে সুন্দর বৃত্তাকার তৃণভূমিতে এসে উপস্থিত হল। তারপর তিন জনে সাজির ওপর উঠে বসে আকশের বুকে মিলিয়ে গেল। ভেসে গেল এমন এক স্থানে, যেখানে না কোনও পাখি যেতে পারে, না পৌঁছাতে পারে মানুষের চোখের দৃষ্টি।

তারাদের দেশে ফিরে আসার পর তাদের নিয়ে চলতে থাকল শুধু খুশি ও আনন্দের মেলা। এই উপলক্ষে প্রধান তারা অন্য তারাদের এক ভোজ সভায় নিমন্ত্রণ করল। তারপর সকলে এসে উপস্থিত হলে ঘোষণা করল যে অন্যেরা নিজের নিজের স্থানে আগের মতো জীবন কাটাতে পারে বা পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা উপহার নিজের পছন্দ মতো তুলে নিতে পারে। এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখা গেল যে উপস্থিত সকলেই দ্রুত পদক্ষেপে এসে ওয়াউফির আনা উপহার তুলে নিতে থাকল। কেউ জন্তুর পা বেছে নিল, কেউ লেজ, কেউ নখর, কেউ পাখির ডানা ইত্যাদি। যারা লেজ বা নখর নিল, তারা বন্য জন্তুতে পরিণত হয়ে ছুটে পালাল। কেউ পাখি হায়ে উড়ে গেল। ওয়াওফি একটা সাদা বাজপাখির পালক বাছল এবং তার স্ত্রী ও সন্তান তাকেই অনুসরণ করল। তারা সবাই সেই মতো বাজপাখিতে পরিণত হল। সে ডানা মেলে স্ত্রী, পুত্র ও অন্যান্য পাখিদের সঙ্গে উড়তে উড়তে পৃথিবীতে ফিরে এল। এখনও লক্ষ্য করলে জঙ্গলের মধ্যে তাকে যেন উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। তার চোখ তারাদের মতো উজ্জ্বল ও ডানার মধ্যে স্বর্গীয় বাতাসের সঞ্চালন। 

 

 *********


Comments

Anonymous said…
খুউব ভালো লাগলো,ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে এক ঝুড়ি গল্প, আরো লিখুন।
Anonymous said…
অশেষ ধন্যবাদ।

Popular posts from this blog

Mission Camera

MISCOMMUNICATION